কলকাতার নিউটাউনে ইনফোসিসের নতুন অফিস উদ্বোধনের উৎসব। পাশেই শ্যাম স্টিলের প্রকল্প। কিন্তু এই উজ্জ্বল ছবির আড়ালে ২,২০০ কোম্পানির পলায়ন! পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই দ্বন্দ্বময় চিত্র নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন।
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি: উন্নয়নের গতি আর অদৃশ্য বাধা
অর্থনীতির হালচাল: আশা-নিরাশার ডালি
২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজ্যের GSDP প্রবৃদ্ধির হার ১০.৫%, যা জাতীয় গড় ৭.৩২%-কে ছাড়িয়ে গেছে। শিল্প-সেবা খাতের অবদানে পশ্চিমবঙ্গ এখন দেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু উজ্জ্বল এই পরিসংখ্যানের নিচে লুকিয়ে আছে কিছু চিন্তার কারণ:
- ১৯৬০-৬১ সালে রাজ্যের GDP-তে অবদান ছিল ১০.৫%, যা ২০২৩-২৪ এ নেমে দাঁড়িয়েছে ৫.৬%
- মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের চেয়ে ২০% কম
- শিল্পপলায়নের উদ্বেগজনক প্রবণতা
বিনিয়োগের উজ্জ্বল দিক
প্রকল্প | বিনিয়োগ | চাকরির সুযোগ |
---|---|---|
ইনফোসিস, নিউটাউন | ৪২৬ কোটি টাকা | ৪,০০০+ |
শ্যাম স্টিল | ২,১০০ কোটি টাকা | ৫,০০০+ |
সিলিকন ভ্যালি প্রজেক্ট | ২৭,০০০ কোটি টাকা (লক্ষ্য) | ৭৫,০০০ (আনুমানিক) |
MSME খাত | ১.৫৩ লাখ কোটি টাকা (লক্ষ্য) | অসংখ্য |
চ্যালেঞ্জের মেঘ
অর্থনীতিবিদ সুমন মুখার্জীর কথায়: "বিনিয়োগ ঘোষণা আর বাস্তবায়নের মধ্যে বিশাল ফারাক। ঘোষিত প্রকল্পের মাত্র ৩% বাস্তবায়িত হয়, যার মূল কারণ স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।" উদ্বেগের প্রধান কারণগুলো:
- ২০১৯-২০২৪ সময়ে ২,২২৭টি কোম্পানির পলায়ন
- তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের অচলাবস্থা
- রাজস্ব ঘাটতি: জাতীয় গড় ০.৪% এর বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গে ২.৬%
- ঋণের বোঝা: GSDP-এর ৩৮.৪%
চাকরির বাজারের দ্বিচিত্র
CMIE-এর তথ্য অনুযায়ী বেকারত্বের হার ৫.৮%, কিন্তু PLFS সমীক্ষায় এই হার মাত্র ২.২%। এই বৈপরীত্য যাই হোক, চাকরির বাজারের কিছু ট্রেন্ড স্পষ্ট:
- অনানুষ্ঠানিক খাতে ৩০ লাখ চাকরি হ্রাস (২০১৫-২০২৩)
- যুব বেকারত্বের উচ্চ হার
- দক্ষতার অভাব: শিল্পের চাহিদা আর কর্মীর দক্ষতার মধ্যে ফারাক
- মহিলা শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ: ৩৩.৮% (জাতীয় গড়ের নিচে)
উন্নয়নের মডেল: গ্রামীণ বাংলার সংগ্রামী নারী
পুরুলিয়ার 'মুক্তিধারা' প্রকল্পে গায়ত্রী পারামানিকের সাফল্য গ্রামীণ অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়:
- সাথী মহিলা সমিতি থেকে ৭,০০০ টাকা ঋণ
- মাচা পদ্ধতিতে সবজি চাষ
- মাত্র ৩ মাসে ৯,৯৩২ টাকা লাভ
- স্থায়ী মাসিক আয়: ৩,৩০০ টাকা
মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে হাজারো সংগ্রামী নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটছে:
- সুতপা (নদিয়া): ঢাকাই জামদানি শাড়ি ব্যবসায় সাফল্য
- মামনি দাস (উত্তরবঙ্গ): বাঁশের মাচাতে মাসে ১৫,০০০ টাকা আয়
- ২৩.৮ লাখ মহিলা মাইক্রোফাইন্যান্স সুবিধাভোগী
স্টার্টআপ জগতে বাংলার জয়যাত্রা
কলকাতা ভারতের ৯ম সেরা স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম। উল্লেখযোগ্য সাফল্য:
- Wow! Momo: ৮০০+ আউটলেট, ৪৪০ কোটি টাকা বার্ষিক আয়
- Rare Planet: শার্ক ট্যাঙ্ক ইন্ডিয়ার পর মাসিক বিক্রি ৭৫ লাখ থেকে ৪ কোটি টাকা
- SleepyCat: ম্যাট্রেস ব্যবসায় ৫০ কোটি টাকা বার্ষিক আয়
সাংবাদিকের নোটবুক
"উন্নয়নের পথে পশ্চিমবঙ্গের যাত্রা অমসৃণ। একদিকে ইনফোসিস-টাটার মতো বিনিয়োগ, অন্যদিকে শিল্পপলায়নের মর্মান্তিক পরিসংখ্যান। গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন আশার আলো দেখালেও, যুব সমাজের জন্য পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এখনও চ্যালেঞ্জ। ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট হয়ত নতুন দিগন্ত খুলে দেবে - কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ইচ্ছা ও আমলাতান্ত্রিক বাধার অবসান।"
ভবিষ্যতের রাস্তা
বিশেষজ্ঞদের মতে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন:
- শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি
- যুবাদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ
- কৃষি ও এমএসএমই খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি
- অবকাঠামো উন্নয়নে ত্বরিত পদক্ষেপ
- রাজস্ব ঘাটতি কমানোর কঠোর পদক্ষেপ